পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্যা ও ভূমিধসের কারণ রাজনৈতিক


বিধান চাকমা ও সমরেশ
ত্রিপুরা



গত কয়েকদিন ধরে লঘু
বৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার
(৮ আগস্ট ২০২৩) পযন্ত রাঙামাটিতে ২৩৫টি ভূমিধসের খবর পাওয়া গেছে এবং বন্যার কারণে
৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভূমিধসের কারণে প্রাণহানি না ঘটলেও ১০ জন আহত
হয়েছে। বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট বন্যায় বান্দরবান শহর তলিয়ে গেছে।



পার্বত্য চট্টগ্রামের
এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনেকে মনুষ্যসৃষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা
ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বৃষ্টিপাতের মাত্রা বৃদ্ধি, পূর্ণিমার জোয়ারের
কারণে দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে পানি নামতে দেরী হওয়া, পাহাড় কাটা ও বন উজারসহ ভূমি ব্যবস্থাপনার
পরিবর্তনকে এর জন্য দায়ী করেছেন।

ভূমিধসের চিত্র । ছবি: সংগৃহিত

আসলে মূল কথা হলো,
পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্যা ও ভূমিধসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের তা
ক্ষণিক কারণ হিসেবে অনেক বিষয়কে
চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু মূল কারণ যা, তা কেউ বলতে চান না। সামগ্রিক স্বার্থে আমাদের
অবশ্যই সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। পাহাড়ে বন্যা ও ভূমিধসের মূল কারণ হলো এ অঞ্চলে
কৃত্রিমভাবে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটানো।



সবাই জানেন, যে কোন
দেশে পাহাড়ি অঞ্চলে জন-ধারণ ক্ষমতা কম হয়ে থাকে। ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যিই এর
কারণ। এখন এই প্রাকৃতিক নিয়মকে লঙ্ঘন করা হলে প্রকৃতি অবশ্যই বিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে
– এটাই স্বাভাবিক। পাকিস্তান আমলে এক সার্ভের রিপোর্ট মতে বৃটিশ আমলের শেষের দিকেই
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি পেয়েছিল। ১৯৬০ দশকে কাপ্তাই বাঁধের
কারণে ৫৪ হাজার একর প্রথম শ্রেণীর ধান্য জমি পানিতে তলিয়ে গেলে জমির ওপর চাপ আরও বেড়ে
যায়। লোকজনকে পুনর্বাসনের জন্য রিজার্ভ ফরেস্ট উন্মুক্ত করে দিতে হয়। তারপরও ৬০ হাজার
পাহাড়ি জমি না পেয়ে জুম চাষে ফিরে যেতে বাধ্য হয় এবং ৪০ হাজার জন ভারতের অরুণাচলে চলে
যায়।

বন্যায় ডুবে গেছে বান্দরবান শহর। ছবি: সংগৃহিত

এই অবস্থায় পাকিস্তান
আমল থেকে বহিরাগত বাঙালি ও বিহারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন দেয়া শুরু হয়,
যা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এবং বিশেষত গত শতকের ৭০ দশকের শেষের দিকে এবং ৮০ দশকের
প্রথম ভাগে আরও বৃদ্ধি পায়। এ সময় আনুমানিক ৪ লক্ষ বহিরাগত বাঙালিকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে
নিয়ে আসা হয়। এই বহিরাগতদের জন্য বাড়তি জমি না থাকায় পাহাড়িদের জমি কেড়ে নিয়ে সেখানে
তাদেরকে পুনর্বাসন দেয়া হয়। আর এই প্রক্রিয়ায় আরও হাজার হাজার পাহাড়ি জমি হারিয়ে জুম
চাষে নিয়োজিত হতে বাধ্য
 হয়।



পার্বত্য চট্টগ্রামে
বহিরাগত পুনর্বাসনের উদ্দেশ্য হলো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক – এক কথায় পাহাড়িদেরকে তাদের নিজ
মাতৃভূমিতে সংখ্যালঘু করা। কিন্তু সরকারী পরিকল্পনা মতো পাহাড়িরা ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু
হয়ে গেলেও, এই বহিরাগত পুনর্বাসনের অন্যরূপ ফলও সৃষ্টি হয়েছে। জনমিতির চেহারা পাল্টে
যাওয়ার সাথে সাথে এই এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে গেছে। জনসংখ্যার বৃদ্ধির
কারণেই বন উজার হয়েছে, ভূমির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এসেছে এবং পাহাড় কেটে
চাষ ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে হচ্ছে। বহিরাগত পুনর্বাসনের বর্তমান এই পরিবেশগত ফল অনেক
আগেই অনুমান করা হয়ে।
Genocide
in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh
বইয়ে Wolfgang Mey (ed.) লিখেছেন, `The ruthless
extraction of forest produce combined with the large scale settlement of
Bengali peasant families will soon destroy the natural environment. Tropical
rainforests exist by the grace of a delicate balance, which once disrupted,
will not be reestablished.’ (p. 118)
প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হলে পরিবেশগত বিপযয় যে অবশ্যম্ভাবী
তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না।



কোন সমস্যার মূল
ও প্রকৃত কারণকে চিহ্নিত করা না গেলে এবং সেই কারণকে দূর করা না হলে সেই সমস্যার সমাধান
আশা করা যায় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মূল কারণ যে কৃত্রিমভাবে
জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটিয়ে পাহাড়ি জনগণকে নিজ মাতৃভূমিতে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার উদ্যোগ
তা স্বীকার করতে হবে এবং সেই মোতাবেক পদক্ষেপ নিতে হবে। সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে
একমাত্র বহিরাগতদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে থেকে সরিয়ে নিয়ে সমতলে পুনর্বাসন করা এবং
পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দেয়া। তা না হলে পাহাড়ে বন্যা ও ভূমিধসের মতো প্রাকৃতিক
দুযোগ বন্ধ করা যাবে না, বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে।#



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।


 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url