কেন জেএসএসের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন ভণ্ডামি?

মুক্তমত



সোহেল চাকমা




সত্তর দশকে এম.এন লারমার নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া পার্বত্য
চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সংক্ষেপে পিসিজেএসএস) একসময় পাহাড়িদের জনজীবনে অন্ধকার ভেদ
করে আলো ফোটাবার ন্যায় আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছিল। বিশেষ করে একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার
পর উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে স্বতঃসিদ্ধ এক প্রতিবাদী প্রতীকে পরিণত হয় দলটি।
দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনায় পীড়িত পাহাড়িদের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভার পড়ে যায় জেএসএসের উপর।
কালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের
পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পাহাড়ি জনগণের
দেখভাল করার দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই জেএসএসের উপরই এসে বর্তায়। এর একটি অন্যতম কারণ
হল ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি শান্তিবাহিনীর আত্মপ্রকাশ। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শান্তিবাহিনীর
সশস্ত্র কার্যক্রম সেই সময়ে মুখোমুখি বসবার বনলতা সেনের মতো পাহাড়ি জনগণের মুক্তির
আকাঙ্ক্ষাকে সংগ্রামের দিকে ধাবিত করেছিল। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর নিপীড়নে যখন পার্বত্য
চট্টগ্রামের সর্বত্র জুম্ম জনগণ অতিষ্ঠ, পিষ্ট ও ভোগান্তিত ঠিক সেই মূহুর্তে শান্তিবাহিনীর
গেরিলা সংগ্রাম পাহাড়িদের জনমানসে সাহস যুগিয়েছে মাথা উচু করে বাঁচবার। কিন্তু তা বেশীদিন
দীর্ঘস্থায়ী থাকেনি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে হওয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেনসন্তু লারমা । ছবি: সংগৃহিত

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যার পর দেশে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হলে এম.এন লারমা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান এবং জেএসএসের নেতৃত্ব গ্রহণ
করেন। তার নেতৃত্বেই জেএসএস ও শান্তিবাহিনীর কার্যক্রম পাহাড়ি জনগণকে দ্রুত সাঁড়া ফেলে
দেয়। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে বহিরাগত সেটলার বাঙালি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করা, সেনাবাহিনীর
নিপীড়ন-নির্যাতন প্রতিরোধ ও ভূমি বেদখলের বিরুদ্ধে জেএসএস ও শান্তিবাহিনী পার্বত্য
চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এক আলোচনার ঝড় সৃষ্টি করে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে
পাহাড়ি জনগণ যখন জেএসএসের উপর আস্থা ও ভরসা খুঁজে পেয়েছিল তখন ডান-বাম চিন্তা না করেই
সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্ত
অংশগ্রহণ করেছিল এবং ব্যাপক সমর্থন যুগিয়েছিল। যা সেসময়ে পাহাড়িদের অধিকার প্রতিষ্ঠার
সংগ্রামে এক মোক্ষম সুযোগ তৈরি করেছে, যার পরিণতি হতে পারত সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক
লড়াই মুক্তি। কিন্তু জেএসএস নেতৃত্ব জনগণের সেই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ শক্তিকে রাজনৈতিক
মুক্তির লড়াইয়ে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়। যেখানে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে
তুমুল গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠার কথা, সেখানে এমন এক উত্থাল সংগ্রামের সন্ধিক্ষণে ১৯৭৫ সালে
৩০ আগস্ট (রুপায়ন দেওয়ানের ভাষ্যমতে, ২৬ অক্টোবর) শান্তিবাহিনীর গেরিলা প্রধান সন্তু
লারমা খুব সাদামাটাভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। যা পরবর্তীতে জেএসএস আন্দোলনে মহাসংকটের
জন্ম দেয়।



আশির দশকের শুরুতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক হারে
সেটলার পুনর্বাসন শুরু করে। সেটলারদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে শান্তিবাহিনীর তখনকার
নেতৃত্ব 'ফেনী এক্সপেডিশন' পরিচালনা করে। অনেকের মতে, যা ছিল ত
কালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জেএসএসের
একটি উপর্যুপরি পদক্ষেপ। বস্তুত, সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামে জোরপূর্বক পুনর্বাসন
ঠেকানো ও ভূমি রক্ষায় 'ফেনী এক্সপেডিশন' কার্যকর ছিল বলে জানা যায়। ১৯৮০ সালের ২২ জানুয়ারি
সন্তু লারমাকে কারামুক্তি দেয়া হলে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। তিনি সদ্য কারামুক্ত অবস্থায়
  সশস্ত্র দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ
করার পর 'ফেনী এক্সপেডিশন' বন্ধ করে দেন। এরপরে সেনাবাহিনী এবং সেটলারদের বিরুদ্ধে
কোন সশস্ত্র প্রতিরোধ সেভাবে আর গড়ে ওঠেনি। মূলত সন্তু লারমা'র বিনাবিচারে আটক ও জেলমুক্তি,
পুনরায় সশস্ত্র দলের প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ, ফেনী এক্সপেডিশন অভিযান বন্ধ ইত্যাদি
নানা কারণে জেএসএস তখন ভয়াবহ দলীয় সংকটে পতিত হয় এবং আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার
ধারণ করার ফলে সেইটা সমাধান করতে গিয়ে জেএসএস নেতৃত্ব হিমশিম খাচ্ছিল। সেই সুযোগে রাষ্ট্রীয়
শাসকগোষ্ঠী তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার অবাধ স্বাধীনতা পায়। ফলশ্রুতিতে, জিয়াউর
রহমানের চার লক্ষ বহিরাগত বাঙালি সেটলার পুনর্বাসন পরিকল্পনা সম্পন্ন হয়ে যায়।
 



শাসকগোষ্ঠীর হাতে ধৃত সন্তু লারমা'র নিঃশর্ত জেলমুক্তি এমন
এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হয়েছিল যা পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বদলে দেয়।
সন্তু লারমা'র সাদামাটা গ্রেফতার ও মুক্তি জেএসএসের সশস্ত্র লড়াই-সংগ্রামে দুটি তা
পর্যপূর্ণ ঘটনা। এ নিয়ে জনমনে এখনো
নানা যুক্তি-তর্ক ও মত-পার্থক্য রয়েছে। কি কারণে কিংবা কোন উদ্দেশ্যে সন্তু লারমা'কে
দীর্ঘ প্রায় ৪ বছর জেলে আটক রাখার পর মুক্তি দেওয়া হয়েছিল? দুরভিসন্ধিমূলক কোন উদ্দেশ্য
না থাকলে একজন সশস্ত্র দলের গেরিলা প্রধানকে শাসকগোষ্ঠী অবশ্যই এত সহজে মুক্তি দেওয়ার
কথা নয়? ফলে এ নিয়ে সেসময় নানা আলোচনার জন্ম দেয়। কারণ সেসময়ে একজন শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র
গেরিলা সদস্য কিংবা একজন নিরীহ পাহাড়িকে শান্তিবাহিনীর তকমা দিয়ে আটক করা হলেও সহজে
ছাড়া পাওয়ার কোন উপায়ান্তর ছিল না। সুতরাং তার চাইতেও নিশ্চয়ই অনেক বেশি কঠিন ছিল গেরিলা
প্রধানের মুক্তিদান। সন্তু লারমা'র এহেন রহস্যজনক মুক্তির অর্থ তখনই আমরা বুঝতে পারি
যখন সন্তু লারমা'র সাংগঠনিক কার্যক্রম ও ভূমিকা পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক স্বার্থে
বিবেচনায় করা হয়।
 



কালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, শান্তিবাহিনীর
পরতায় যখন সেটলার ও সেনাবাহিনী
কোনঠাসা হয়ে পড়ছিল, যখন আতঙ্কে ও ভয়ে সেটলার ও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে
আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিল ঠিক ঐ সময়েই সন্তু লারমা'কে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের
উদ্ভুত পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করতে ও জেএসএসের সাথে সরকারের সেতুবন্ধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে
একপ্রকার 'শান্তির দূত' হিসেবে প্রেসিডেন্ট জিয়া কৌশলগত কারণে সন্তু লারমা'কে মুক্তি
প্রদান করেন। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।



বলাসঙ্গত যে, সন্তু লারমা মুক্তির পরপরই জেএসএসের দলীয় সংকট,
অন্তঃকোন্দল তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। অনেকেই মনে করেন, শান্তিবাহিনী তথা জেএসএস ভাঙার
জন্যে ত
কালীন প্রেসিডেন্ট জিয়া সন্তু লারমাকে
মুক্তিদান পূর্বক পাহাড়ি জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিলেন। যা সন্তু
লারমা'র জেলমুক্তির পরে কার্যকর হয়েছিল। প্রবাহন ম্যাগাজিনে রুপায়ন দেওয়ান লিখেছেন,
জেলবন্দি অবস্থায় সন্তু লারমা সরকারের কাছে ৪৩ পৃষ্ঠার একটি গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর
করেন। যা ছিল সন্তু লারমা'র মুক্তির সনদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে এই ৪৩
পৃষ্টার গোপন চুক্তিকে প্রীতিকুমার 'আপসনামা' হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। সন্তু লারমা'র
৪৩ পৃষ্ঠার সেই গোপন চুক্তিতে আসলে কি ছিল এবং কি রয়েছে তা জেএসএসের পরিণতি, অবস্থান
ও বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ
করলে কিছুটা আন্দাজ করা যায়।



সন্তু লারমা কারামুক্তির পর জেএসএসের সশস্ত্র আন্দোলনে ভাটা
পড়ে যায়। পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংকট সামাল দিতেই হিমশিম খায় দলটি। সেই আভ্যন্তরীণ
দ্বন্ধ একসময় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে রুপ নেয়। যার হিংসা-প্রতিহিংসার আগুনে বলি হন মানবেন্দ্র
নারায়ন লারমা। তারপরও জেএসএসের ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের বস্তুনিষ্ঠ কোন সমাধান হয়নি। বরং
তা জেএসএসের আন্দোলনে এক বিশাল ক্ষত তৈরি করেছে এবং ত
কালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী
মানুষের বাঁচার স্বপ্নকে ধূলিসা
করে দিয়েছে। 



জেএসএসের তকালীন রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায় 'রণনীতিগতভাবে
দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম ও রণকৌশলগতভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি লড়াই' তত্ত্বের বদৌলতে জেএসএস
লাম্বা-বাদি গ্রুপে ভাগ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিলেন সন্তু লারমা এবং প্রীতি কুমার
চাকমা। দুইজনের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি পুরো জেএসএস এবং শান্তিবাহিনীর গেরিলা
সংগ্রামকে নিমিষেই অঘোর দুঃস্বপ্নের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
 



জেএসএসের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাতে রুপ নেয় ১৯৮৩ সালের
১৪ই জুন এমএন লারমা ও সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন লাম্বা গ্রুপ কর্তৃক প্রতিপক্ষ প্রীতি
নেতৃত্বাধীন বাদী গ্রুপের উপর সশস্ত্র হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে। 'পানছড়ি গোলকপুদিমা'
ছড়ায় সংঘটিত এ হামলায় অস্ত্র গুরু বলি ওস্তাদ (অমৃতলাল চাকমা) শহীদ হন এবং জেএসএস লাম্বা-বাদী
গ্রুপের ভ্রাতৃঘাতি সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। যার পরিণাম ভয়াবহ রক্তাক্ত ১০ নভেম্বর।
১৯৮৩ সালের এই দিনে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে জেএসএস প্রতিষ্ঠাতা এম.এন. লারমা'কে হত্যার মধ্যে
দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী মানুষের রাজনৈতিক বিজয়ের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করা
হয়েছে। যার দায় বর্তমান জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা এবং প্রীতি কুমার কোনভাবেই এড়াতে
পারেন না। বলা আবশ্যক যে, এম.এন লারমা'কে হত্যার মাধ্যমে প্রীতি ও সন্তু লারমা
 একদিকে যেমন জেএসএসকে ভেঙ্গেছে,
জেএসএস তথা পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিকামী গণ-আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করেছে, অন্যদিকে
সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে সন্তু লারমা ৪৩ পৃষ্ঠার গোপন ও আপোষচুক্তির স্বার্থও
বজায় রেখেছে। এর ফলে পুরো পার্বত্য জনপদে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো পুষিয়ে উঠতে
পারেনি পাহাড়ি জনগণ।



এম.এন লারমা মৃত্যুর পর জেএসএস তথা পাহাড়ি জনগণের আদর্শিক
ও বস্তুনিষ্ঠ রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলন আর রক্ষিত থাকেনি। যে স্বপ্ন ও মুক্তির আশায়
বুক বেঁধে বৈষয়িক জীবনের সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে লারমা সংগ্রামে নেমেছিলেন সেই সংগ্রাম
যেন অচিরেই নির্বাপিত হয় কবরে। ১৯৮৫ সালের ২৯ এপ্রিল রাঙামাটি স্টেডিয়ামে ত
কালীন ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি
মেজর জেনারেল নুরুদ্দীন খানের
কাছে ২৩৩ জন সৈন্য নিয়ে কিছু দাবীনামা শর্তে বাদি গ্রুপ অস্ত্রসমর্পন করে। শেষ হয়ে
যায় লারমা'র নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া জেএসএস একাংশের বিশাল বড় শক্তির। এতে শাসকগোষ্ঠীই
সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল। একসময়কার শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত থাকা দুশোরও
অধিক মুক্তির সৈনিককে নিরস্ত্র করার সাফল্যে আধিপত্যবাদী শাসনকাঠামোকে প্রতিষ্ঠিত করার
একটা বিরাট সুযোগ পেয়েছে উগ্রবাদী সরকার-শাসকগোষ্ঠী।
 



১৯৭২ - ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত জেএসএস বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে
শান্তিবাহিনীর দ্বারা সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করলেও বেশীরভাগ সময়ই পার্টিগত আন্তঃকোন্দল,
মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদি সামাল দিতে গিয়ে কার্যত কোন পদক্ষেপে সফলতার মুখ দেখেনি।
শান্তিবাহিনীর চোখের সম্মুখেই সমতল থেকে বাঙালি সেটলার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত
হয়। আশির দশকে ৪ লক্ষ বাঙালি সেটলার পুনর্বাসনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের
জনমিতিকে নিমিষেই বদলে দিয়েছে। যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান বাঙালি জনসংখ্যার
অনুপাত পাহাড়িদের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। যেখানে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় পার্বত্য
চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ২%।



প্রসঙ্গত, জেএসএসের বাদী গ্রুপ অস্ত্র সমর্পণের পর সন্তু
লারমা নেতৃত্বাধীন লাম্বা গ্রুপ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার একাধিপত্য বিস্তার করে।
কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতা, জনসম্পৃক্ততা ও গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রাম জারী না থাকায়
ব্যাপক জনসমর্থন থাকার পরেও জেএসএস বাঙালি পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে
পারেনি। এই ব্যর্থতার গ্লানি চেপে রেখে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জেএসএস পাঁ বাড়ায় আলোচনার
দিকে। আলোচনার প্রাক্কালে একদিকে
  শাসকগোষ্ঠী ভূমি বেদখল, নারী ধর্ষণ,
ধরপাকড় ও সাম্প্রদায়িক হামলা অব্যাহত রাখলেও অন্যদিকে সন্তু লারমা বন্ধ রাখেন জেএসএসের
সশস্ত্র সংগ্রাম। ফলে শান্তিবাহিনী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে ও হতাশায় নিমজ্জিত হতে
থাকে। একটা পর্যায়ে ভঙ্গুর ও দুর্বল মনোচিত্তের কর্মীবাহিনী নিয়ে সন্তু লারমা ধর্ণা
দেন শাসকগোষ্ঠীর কাছে। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পাহাড়ি জনগণের ন্যায্য দাবী আদায়ের
সংগ্রামকে শাসকগোষ্ঠীর কাছে সঁপে দিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে এক চুক্তিতে সই করেন
সন্তু লারমা। এককথায়, অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয় জেএসএস। যেটাকে CHT Accord বা পার্বত্য
চুক্তি নামে আখ্যায়িত করা হয়। শাসকগোষ্ঠী যার নাম দিয়েছে 'শান্তি চুক্তি'।
 



চুক্তির পরবর্তী
জেএসএসের অবস্থান:



পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পর জেএসএস ও আওয়ামীলীগ দেশের
সর্বত্র বিশেষ করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে শান্তির বানী প্রচার করতে থাকে।
শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন মিডিয়া, সংবাদপত্র, ইন্টারনেট ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে এবং জেএসএস
স্থানীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত
হয়েছে বলে দলমত প্রচার করে। সেসময় তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্ভাব্য প্রায় ৯৯% পাহাড়ি
জনগণের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়।
 



বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে চুক্তি সম্পাদনের
পর জেএসএসের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়। তারা পরিণত হয় আওয়ামী লীগের
সাব-দলে। অর্থা
জেএসএস আওয়ামী লীগের অধীনস্থ এক
ধার তলোয়ারবিহীন রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। চুক্তিপন্থী, সরকারপন্থী হিসেবে নিজেদের জাহির
করা এবং একইভাবে সরকারপন্থী রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার প্রবণতা স্পষ্টই সেই
ইঙ্গিত দেয়। শাসক-সরকারের লেজুড় দল হিসেবে জেএসএস দলীয়গত স্বার্থে পার্বত্য চুক্তি
অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে বরাবরই উন্নয়নের লেবাসধারী আওয়ামীলীগের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
পক্ষান্তরে শাসকগোষ্ঠীর সাথে এক দুর্বল চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে যবনিকাপাত ঘটে জেএসএসের
রাজনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের।
 



চুক্তির পর কথার রাজনীতি ব্যতীত জেএসএস কার্যত কোন পদক্ষেপ
ও কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারেনি। পার্বত্য চুক্তির উছিলায় সেনাশাসনের বিরুদ্ধে, ভূমি
দখলের বিরুদ্ধে কিংবা রাষ্ট্রীয় উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোনো
পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। কিংবা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার
স্বপ্নও তারা দেখতে পারেননি। যদিও সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাসী জেএসএস নেতৃবৃন্দ গণতান্ত্রিক
লড়াই- সংগ্রামে বিশ্বাসী নয় বলে দলমত প্রচার করেন। কথা হচ্ছে, পার্বত্য চুক্তির দাবীনামা
কার্যকর না হওয়া সত্ত্বেও জেএসএস উল্টো সেনাবাহিনী, শাসক, আমলা ও সরকারের সাথে তাদের
সহাবস্থান বজায় রেখেছে। শুধুমাত্র দল টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জেএসএসের এমন রাজনৈতিক
অবস্থান জনমনে প্রশ্ন জাগায়, জেএসএসের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন আসলেই কি পাহাড়ি
জাতিসত্তার জনমুক্তির সংগ্রামকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে?
 



কেন জেএসএসের চুক্তি
বাস্তবায়নের আন্দোলন ভন্ডামি?
 



পার্বত্য চুক্তির মধ্যে যদি দুর্বলতা ও অসঙ্গতি না থাকে
তাহলে জেএসএসের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন প্রতিবছর চুক্তির বর্ষপূর্তি পালন, গুটিকয়েক
সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতি, নবীন বরণ কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই কেন সীমাবদ্ধ
থাকবে? চুক্তির বর্ষপূর্তি দিবসে সেই একই কর্মসূচীগুলো তো সেনাবাহিনী, সেটলার, আমলা,
মন্ত্রী এককথায় সরকারও পালন করে থাকে। শাসক সরকারের সাথে জোট বেঁধে যদি আচার-অনুষ্ঠান
সম্পন্ন করা যায়, যদি কোন আদর্শিক দ্বন্দ্ব না থাকে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীকার
প্রতিষ্ঠার জন্যে জেএসএস কার বিরুদ্ধে চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন করছে? এছাড়া ৯ আগষ্ট
একদিন ডাক ঢোল পিটিয়ে ‘আদিবাসী দিবস’ উদযাপনই কি জেএসএসের মূখ্য কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছে?
উল্লেখ্য, যে জেএসএস পার্বত্য চুক্তির ১নং ধারায়
  ‘পাহাড়িদের উপজাতি এবং পার্বত্য
অঞ্চলকে উপজাতিয় অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হইবে বলে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে
সেই জেএসএস এখন ডাক ঢোল পিটিয়ে বছরের পর বছর ৯ আগষ্ট এলেই ‘আদিবাসী দিবস’ উদযাপন করছে!
যা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও হাস্যকর ব্যাপার! প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে আদিবাসী স্বীকৃতি পেলেই
কি জেএসএসের পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হবে? কিংবা সরকার আদিবাসী স্বীকৃতি দিলেই কি
পাহাড়িরা তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবে? জেএসএস কার স্বার্থে এই জাঁকজমকপূর্ণ আদিবাসী
দিবস উদযাপন করে?



তাহলে কি আমরা ধরে নেব আদিবাসী দিবস পালনই জেএসএসের চুক্তি
বাস্তবায়নের মৌলিক আন্দোলন? যদি তাই না হয় তাহলে আদিবাসী দিবস ব্যতীত অন্য কোনদিন জেএসএস
কেন চুক্তি বাস্তবায়নের কর্মসূচি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করছে না? শুধুমাত্র আদিবাসী দিবস
একদিন পালন করে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবী তুললেই কি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব?
নাকি এটি শুধু জেএসএসের সময়ের উল্লাস কিংবা কোন লোকদেখানো আবেগ? নয়তো কেন এবং কি কারণে
জেএসএস চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাস্তবসম্মত কোন কার্যপদক্ষেপ ও কর্মসূচী নিতে পারেনি?
কিংবা বর্তমান সময়ে এসেও কেন চুক্তি বাস্তবায়নের কর্মসূচী নেয়া হচ্ছে না? সেটা সশস্ত্র
হোক কিংবা গণতান্ত্রিক আন্দোলন হোক জুম্ম জনগণের সমর্থন তো রয়েছেই। তাহলে জেএসএসের
চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন কোথায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে?



২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি রাঙামাটি বিলাইছড়িতে ১৩ বেঙ্গলের
অধীন ফারুয়া সেনা জোনের সুবেদার মিজানের নেতৃত্বে তল্লাসীর নামে দুই সেনা সদস্য কর্তৃক
নিজ বাড়িতে দুই মারমা কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয় এবং সেই ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৫ই
ফেব্রয়ারি ২০১৮ জেএসএসের প্রাণকেন্দ্র রাঙামাটির কেন্দ্রস্থলেই রাণী ইয়ান ইয়ান এর ওপর
সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কর্তৃক বর্বরোচিত ও ন্যাক্কারজনক হামলা করা হয়। জেএসএস
যদি সত্যিকার অর্থে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, জাতি মুক্তির সংগ্রামে অবিচল থাকে
কিংবা চুক্তি বাস্তবায়ন চায় তাহলে দুই মারমা কিশোরী ধর্ষণ ও রাণী ইয়ান ইয়ানকে অপদস্থ
করার পরও কেন টু শব্দ করল না? এটা কি পার্বত্য চুক্তির লঙ্ঘন কিংবা অবমাননা নয়?
 



২০১৬ সালে আলুটিলায় সেনাবাহিনী কর্তৃক পর্যটনের নাম করে
৭০০ একর ভূমি দখল করার চেষ্টা করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ২ জুন রাঙামাটির লংগদুতে সেনাবাহিনীর
প্রত্যক্ষ মদদে সেটলার বাঙালি কর্তৃক পাহাড়ি গ্রামে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো
হয়। চারটি গ্রামে অগ্নিসংযোগের ফলে ২৫০টি বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়াও ঘর থেকে
পালাতে না পেরে গুণমালা চাকমা নামে এক ৭৫ বছরের বৃদ্ধা জীবন্ত অগ্নি ভস্মীভূত হয়। এছাড়াও
২০২০ সালে পাঁচ তারকা হোটেল স্থাপনের নামে বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে সেনাবাহিনী ও
সিকদার গ্রুপ কর্তৃক ম্রো জাতিসত্তাদের ৮টি গ্রাম উচ্ছেদ করে ৮০০ একর ভূমি দখল করা
হয়। অতি সম্প্রতি লামায় 'লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ' কর্তৃক ত্রিপুরা ও ম্রোদের ৪০০ একর
জুমভূমি দখলের পায়তারা করা হয়েছে (যা এখনো চলমান রয়েছে) এবং সেনাবাহিনীর মদদে সেটলার
দোসরদের কর্তৃক বাগান-বাগিচা পুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট ও একমাত্র
পানির উ
স ঝিরিতে বিষ ছিটিয়ে ম্রো ও ত্রিপুরা
জাতিসত্তাদের হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে (যা বর্তমান সময়ে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে
দাঁড়িয়েছে)। অথচ জেএসএস কোন আপ্তবাক্য উচ্চারণ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, জেএসএস যদি সত্যিকার
অর্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি রক্ষার আন্দোলন করে, কিংবা তাদের দাবী অনুযায়ী চুক্তি
মোতাবেক ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাহলে পাহাড়ের আলুটিলা, চিম্বুক, লামাসহ সর্বত্র
দখলে যাওয়া দেখেও জেএসএস কেন কোন কর্মসূচী গ্রহণ করেনি? কিংবা অন্যকোন পদক্ষেপও কেন
নিতে পারেনি? তাহলে ভূমি রক্ষার আন্দোলন কি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন নয়?
এইটা কি জনগণের ব্যর্থতা? নাকি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ না করার
ফল? এটা কি জেএসএসের অজ্ঞতা নাকি অজ্ঞানতা?
  লংগদু পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়াও কি
জেএসএসের স্বাভাবিক মনে হয়? এটা কি পার্বত্য চুক্তির সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে
না? [খোদ পার্বত্য চুক্তিটিও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয়, এককথায় অসাংবিধানিক; সরকার
চাইলেই যে কোন সময় তা বাতিল করতে পারে]



৩ জানুয়ারি ২০২৩ প্রকাশিত এক কেন্দ্রীয় রিপোর্টে জেএসএস
নিজেই বলছে, ২০২২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৩৫টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এসব
ঘটনায় ১ হাজার ৯৩৫ জন পাহাড়ি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। এছাড়া ভূমিদস্যুদের মাধ্যমে
সংঘটিত ৪০টি হামলার ঘটনায় ৪৪৮ জন পাহাড়ি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে।
  সংযোগ সড়ক নির্মাণের ফলে বাঘাইছড়িতে
১৮৮টি পরিবারসহ তিন পার্বত্য জেলায় জুম্ম গ্রামবাসীদের অন্তত ৫০০ পরিবারের ঘরবাড়ি,
বসতভিটা ও বাগান ধ্বংস হয়েছে। পাহাড়ের একটা প্রতিবাদী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জেএসএসের
দেখে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না?



জেএসএসের এমন অভিযোগ আমরা পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পর
থেকেই শুনে আসছি। ২৯ ডিসেম্বর ২০০১ সালে আজকের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত চুক্তিপন্থী
ছাত্র একাংশের সম্মেলনে সন্তু লারমা বলেন, ‘চুক্তির নামে অস্ত্র জমা নিয়ে সরকার জুম্ম
জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’ তিনি চুক্তির করার পরে তারপর বুঝেছেন। প্রথম আলোর এক
রিপোর্টে প্রকাশিত ২১ মে ২০১০ শুক্রবার চুক্তিপন্থী ছাত্রদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সন্তু
আবারো বলেন, ‘সংগ্রাম চালিয়ে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য করা হবে।’
  তিনি কার বিরুদ্ধে, কিভাবে সংগ্রাম
চালাবেন স্পষ্টভাবে বলেননি। একইভাবে ২ জুন ২০১০ সালে দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত এক রিপোর্টে
বান্দরবানে জনসংহতি সমিতির দ্বিবার্ষিক জেলা সম্মেলনে সন্তু লারমা বলেছিলেন, ‘শান্তিচুক্তি
বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়িরা আবারো সশস্ত্র সংগ্রামে যাবে’। ইত্যাদি পার্বত্য চুক্তি
নিয়ে শাসকগোষ্ঠী ও জেএসএসের কাছ থেকে এমন অনেক বাণীর ফুলঝুরি আমরা শুনেছি। কিন্তু সরকার
চুক্তিও বাস্তবায়ন করেনি এবং চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেএসএসও কার্যত কোন বাস্তবসম্মত
পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। কেবল জনগণকে মিথ্যার আশ্বাস দিয়ে কালক্ষেপণে মত্ত রেখেছে
জেএসএস। এটা কি পাহাড়ি জনগণকে ঠকানো ও ধোঁকা দেওয়া নয়?



সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে রাজধানীর সুন্দরবন হোটেলে
আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা সরকারের কাছে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিলের
মধ্যে শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ দাবী করেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি
উল্লিখিত সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা না হলে ১ মে ২০১৫ তারিখ থেকে তিন পার্বত্য
জেলায় অসহযোগ আন্দোলনের আল্টিমেটাম দেন। অথচ সরকার ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সন্তু লারমার
দাবীকৃত রোডম্যাপ ঘোষণাও করেনি অন্যদিকে সন্তু লারমাও অসহযোগ আন্দোলনের কোনো কর্মসূচী
ঘোষণা দেন নি।
 



সন্তু লারমা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে যে অসহযোগ আন্দোলনের
ডাক দিয়েছিলেন তা আজ ৮ বছর হতে চলল। কিন্তু আন্দোলনের ছিটেফোঁটা কর্মসূচিও আমরা দেখতে
পাই না। ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা
গান্ধী। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে ব্রিটিশদের পণ্য ও সহায়তা বর্জন করেছিলেন।
পাশাপাশি স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত বর্জন করে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন
গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদিকে জেএসএস অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে সরকার-শাসকগোষ্ঠীর সাথে
রীতিমতো উঠাবসা করছে, রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধাও ভোগ করছে। এতে পাহাড়ি জনগণ বরাবরই
বিভ্রান্তির শিকার, দিকভ্রান্ত। প্রশ্ন জাগে, ২০১৪ সালে সন্তু লারমা'র ঘোষিত অসহযোগ
আন্দোলনের গতিধারা এখনো কি চলমান রয়েছে? যদি অসহযোগ আন্দোলন চলমান থাকে তাহলে সন্তু
লারমা ২০২১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর আয়োজিত রাঙামাটির ম্যারাথন প্রতিযোগীতার
সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে কেন গেলেন? এবং সেখানে গিয়ে কেন বলে আসলেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের
সেনাবাহিনীর কার্যক্রম প্রশংসনীয়’? এটাও কি জেএসএসের অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ছিল?
 



পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হলে যদি আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্তশাসন,
সেনা প্রত্যাহার, সেটলার প্রত্যাহার, ভূমি অধিকার, জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি
ইত্যাদি পাহাড়িদের মৌলিক দাবীগুলো পূরণ হয় তাহলে সন্তু লারমা সশস্ত্র আন্দোলন, অসহযোগ
আন্দোলনের কথা বলে কেন জুম্ম জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছেন? কেন তিনি চুক্তি বাস্তবায়নের
কর্মসূচী ঘোষণা করে জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলছেন না? নাকি শাসকগোষ্ঠীর
খুঁটিতে বাঁধা চিহ্নিত দালালদের মতো সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন জেএসএসের ভেড়ার মতো চিল্লানো
ছাড়া কোন কর্মসূচী নেই? এগুলো কি চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে পাহাড়ি জনগণের সাথে ভন্ডামি
নয়?



শুধুমাত্র অভিযোগ, অনুযোগ করে দাবী আদায় করা যায় না। রাজনৈতিক
মুক্তির দাবী আদায় করতে হলে একটা প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের আদর্শিক লড়াই-সংগ্রাম, যুগোপযোগী
পদক্ষেপ, কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়ন
করার প্রচেষ্টা থাকতে হয়। মহামতি কার্ল মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত
হওয়ার পূর্বে হেগেল'রা শুধু পৃথিবীকে ব্যাখ্যাই করতে পেরেছিলেন। দিতে পারেননি কোন বস্তুনিষ্ঠ
সমাধান। একইভাবে জেএসএস পার্বত্য চুক্তি নিয়ে সরকারকে একের পর এক অভিযোগ, অনুযোগ, প্রশংসা
ইত্যাদি করতে করতে ২৫টি বছর পার করে ফেলেছে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান
হওয়ার বদলে আরো ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মার্ক্সের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব বাস্তবে রুপদান
দিতে হলে কিংবা কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্টা করতে হলে যেমন আন্দোলনের
প্রয়োজন, দরকার সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচী ও পদক্ষেপ তেমনি চুক্তি বাস্তবায়ন
করতে হলে জেএসএসকে আরো কঠোরভাবে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। কিন্তু তলাবিহীন
ঝুড়ি নিয়ে দুর্বল ও অসঙ্গতিপূর্ণ 'পার্বত্য চুক্তি' বাস্তবায়নের আশায় হাঁ করে বসে থাকা
সন্তু লারমা'র জনসংহতি সমিতিকে দিয়ে কার্যত তা আর কোনভাবেই সম্ভব নয়!
 



পুনশ্চঃ [যে শান্তিবাহিনীর গেরিলা প্রধানকে ১৯৮০ সালের ২২
জানুয়ারি ৪৩ পৃষ্ঠার গোপন চুক্তিতে ছেড়ে দেওয়া হয় সেই গেরিলা প্রধান সন্তু লারমা মুক্তির
পরও আসলে সরকারের শৃঙ্খলিত সেই ৪৩ পৃষ্ঠার জেলেই বন্দী ছিলেন। সেজন্য সামর্থ্য থাকা
সত্ত্বেও তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বস্তুনিষ্ঠ সমাধান করতে পারেননি এবং তিনি
আজও সরকারের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেননি।
 



এরপরেও কি পাহাড়ি জনগণ সন্তু লারমা'র চুক্তি বাস্তবায়নের
স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে থাকবে? নাকি জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে, ভূমির রক্ষার আন্দোলনে
নয়া যুগের নয়া পার্টি ইউপিডিএফের কর্মসূচীতে একাত্মতা ঘোষণা দিয়ে লড়াই সংগ্রামে শরীক
হবে? জনগণের কাছে প্রশ্ন তোলা রইল?]



* তথ্য সংযুক্তি-



১. জীবন আমাদের নয়- সিএইচটি কমিশন
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তার ভবিষ্য- উসান মারমা ও নিরুত্তর চাকমা।
(বুকলেট - প্রকাশ মার্চ ২০১৭)
৩. ফিরে দেখা শান্তিবাহিনীর গৃহযুদ্ধ স্বপ্নের অপমৃত্যু-
পল খীসা
৪. Ethnic Movements and Hegemony in South Asia By
kalam Shahed ( Chapter six- tribal Insurgency in the Chittagong hill tracts,
  page no- 203 to 254)
৫. পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রামী ঐতিহ্য, ইউপিডিএফ ও নতুন
দিনের লড়াই-
  প্রসিত বি. খীসা।
৬. পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গেঃ স্বাধীকার-এর নির্বাচিত প্রবন্ধ
সংকলন (১) (পিসিপি)
৭. বিভিন্ন অনলাইন ও সংগৃহীত নথিপত্র। 



* সোহেল চাকমা,
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক,
বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ।



 



 [মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখাগুলো লেখক/লেখকদের নিজস্ব মতামতই প্রতিফলিত ]



 




সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url