রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক গুম-অপহরণের শিকার মাইকেল ও কল্পনা চাকমাসহ গুম হওয়া সকল ব্যক্তিদের সন্ধান দিতে হবে: অমল ত্রিপুরা

ঢাকা প্রতিনিধি, সিএইচটি নিউজ
বুধবার, ৩০ আগস্ট ২০২৩


বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর কেন্দ্রীয়
সাধারণ সস্পাদক অমল ত্রিপুরা রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক গুমের শিকার হওয়া ইউনাইটেড পিপলস
ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর অন্যতম সংগঠক মাইকেল চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের
কালীন সাংগঠনিক
সম্পাদক কল্পনা চাকমাসহ গুম হওয়া সকল ব্যক্তিদের সন্ধান ও স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার
আহ্বান জানিয়েছেন।



আজ বুধবার (৩০ আগস্ট ২০২৩) সকালে ঢাকায় কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা
ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) ভবনে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মিলনায়তন হল রুমে জাতিসংঘ ঘোষিত
আন্তর্জাতিক “গুম প্রতিরোধ দিবস” উপলক্ষে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে গুম
হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ আহ্বান জানান।


আলোচনা সভায় ছাত্র নেতা অমল ত্রিপুরা বলেন, গুম একটি মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক
আপরাধ। এর বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার
২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতা দখলের পর পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে
সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সরকার বিরোধী মতপ্রকাশ করা ব্যক্তিদের গুম-খুন-অপহরণ,
ক্রসফায়ারে হত্যার ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এসব ঘটনার ন্যায় বিচারে প্রত্যাশায় এবং গুমের
শিকার ব্যক্তিদের সন্ধান করতে সরকার, প্রশাসন ও আদালতে গেলেও কোন সুরাহা পাওয়া যায়
না। তদন্তের নামে প্রশাসন কর্তৃক গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের নানা হয়রানি শিকার হতে
হচ্ছে।


আলোচনায় তিনি আরো বলেন, ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক
ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর অন্যতম সংগঠক মাইকেল চাকমাকে ঢাকা নারায়নগঞ্জের কাঁচপুর এলাকা
থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক অপহরণ করে গুম করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন হিল উইমেন্স
ফেডারেশনের ত
কালীন সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে সেনাবাহিনীর
কমাণ্ডার লে. ফেরদৌস গং কর্তৃক অপহরণের পর গুম করা হয়। মাইকেল চাকমা গুমের ৪ বছর ও
কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৭ বছর অতিক্রম হলেও এ রাষ্ট্র তাদের সন্ধান দিতে পারেনি এবং
দোষীদের গ্রেফতার ও বিচার করেনি।



তিনি অবিলম্বে মাইকেল চাকমা, কল্পনা চাকমাসহ গুম হওয়া সকল ব্যক্তিদের
সন্ধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিপীড়ন, নির্যাতন ও খাগাড়াছড়ি-রাঙামাটির
কারাগারের ফটক থেকে পুনঃগ্রেফতার বন্ধসহ সারাদেশে গুম-খুন-অপহরণ-নির্যাতনের মত মানবাধিকার
লঙ্ঘন বন্ধের আহ্বান জানান।



সভায় প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আখতার বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা যখন পঁচাত্তরে তার বাবা-মা-ভাই-বোনদের নিহত হওয়ার কথা বলেন, এখনো দেখি তার
গলাটা ভারি হয়ে যায়। তিনি বিচার করেছেন তাদের (হত্যাকারীদের)। কিন্তু তিনি কী জবাব
দেবেন এই মায়েদের? তিনিও তো মা।'



ফরিদা আখতার আরও বলেন, 'তার (শেখ হাসিনা) ১৪ বছরের শাসনামলে ১২ বছর ধরে
মায়ের ডাক রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছবি হাতে নিয়ে কাঁদছে। বাচ্চারা অপেক্ষা করছে। অনেক বাবা
সন্তানের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে মারা গেছেন।



'এখন যে প্রশ্নটা তোলো দরকার তা হলো, বাচ্চাদের বড় হয়ে ওঠার অধিকার হরণ
করছে এই সরকার। তারা খেলতে পারত। ভালোভাবে বাঁচতে পারত। আনন্দে থাকতে পারত। তাদের জীবন
এখন কান্নায় ভরে গেছে।'



অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, গুমের মতো
অমানবিক কাজ যাঁরা করেছেন, আজ পর্যন্ত তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। অনেক
বাবা-মা প্রশ্ন করেছেন, কেন তাঁদের সন্তানেরা গুম হয়েছেন। অনেক সন্তানও প্রশ্ন করেছে,
তাদের বাবা কেন গুম হয়েছেন। মূলত ভিন্নমতের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে, তাদের
স্তব্ধ করে দিতে এই গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। অবৈধভঅবে ক্ষমতায় টিকে
থাকতেই তাঁরা এসব করছেন।



দেশে গুমের বিচার না হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একদিন এসবের বিচার
হবে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আপনারা যে গুমের বিচার করছেন না, এ দেশের আদালতে
যখন গুমের বিচার হচ্ছে না, এই বিচার না হওয়ার পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁদের আন্তর্জাতিকভাবে
হলেও একদিন অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।’



নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এই সরকার যত দিন
আছে, তত দিন গুম-খুনের বিচার হবে না। পাঁচ বছর আগেও এই কথা বলেছি, এখনো একই কথা বলছি।
এই সরকার হৃদয়হীন সরকার। এই রাষ্ট্র এখন মানবিক নয়, এই রাষ্ট্র এখন গণতান্ত্রিক নয়।
এই রাষ্ট্র এখন ফ্যাসিস্ট।’


মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, যাঁরা গুমের ঘটনায় জড়িত, তাঁদের
চিহ্নিত করতে হবে, বিচারের আওতায় আনতে হবে। জড়িত ব্যক্তি যদি সর্বোচ্চ ব্যক্তিও হন,
তাঁরও বিচার করতে হবে। কারণ, অপরাধী পার পাবেন, এই সুযোগ নেই।



আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন মায়ের ডাক সংগঠনের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আখতার,
ঢাবির অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক সি আর আবরার, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান
মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের
সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক
নারী জোটের আহ্বায়ক তানিয়া রব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর, মানবাধিকার
কর্মী নাসির উদ্দিন এলান, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, মায়ের
ডাকে সংগঠক সানজিদা  ইসলাম, মানবাধিকার কর্মী
নূর খান লিটন। সভায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরাও বক্তব্য প্রদান করেন। এছাড়াও সভায়
বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কর্মীরাও পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।



আলোচনা সভা শেষে আয়োজকরা উপস্থিত সকলকে নিয়ে একটি পদযাত্রা বের করেন।
পদযাত্রাটি আইডিইবি ভবন থেকে শুরু হয়ে নয়া পল্টনে গিয়ে শেষ হয়।



সিএইচটি নিউজে প্রকাশিত প্রচারিত কোন সংবাদ, তথ্য, ছবি ,ভিডিও, কনটেন্ট ব্যবহার করতে হলে কপিরাইট আইন অনুসরণ করে ব্যবহার করুন।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url