বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার থেকে সতর্ক হোন, প্রাকৃতিক বন-পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করুন

 মুক্তমত 


 অমল ত্রিপুরা


সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশ কোড়ল ধ্বংস করার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। কতিপয় ব্যক্তি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই ছবির ঘটনার সাথে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-কে জড়িয়ে নানা সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, জানাচ্ছেন। ছবিটি যিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি ঘটনাস্থল হিসেবে ‘সাজেকের’ কথা উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এটি ঘটেছে দীঘিনালা উপজেলার পাবলাখালী ইউনিয়নের দজর পাড়া গ্রামে। দীঘিনালা মেরুং অঞ্চল থেকে কয়েকজন ব্যক্তি পাবলাখালী বন রিজার্ভ থেকে বাঁশ কোড়ল ভেঙ্গে নিয়ে যাবার পথে ‘পাবলাখালী মৌজা বন সংরক্ষণ কমিটি’র' লোকেরা বাঁশ কোড়লগুলো জব্দ করে ধ্বংস করে দিয়েছে। এ ঘটনার সাথে ইউপিডিএফ’র কোন সংশ্লিষ্ট নেই। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন-পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষার্থে ইউপিডিএফ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে এবং জনসচেতনার লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে। এ জায়গা থেকে ইউপিডিএফভুক্ত গণসংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে বাঁশ কোড়ল বাণিজ্য রোধে যারা ভূমিকা পালন করেছেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বন-পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।

ইউপিডিএফ জনগণের পার্টি হিসেবে সবসময় জনগণের মতামতকে সাধুবাদ জানায় এবং যৌক্তিভাবে পার্টিকে যারা সমালোচনা করেন তাদের সমালোচনাগুলো গ্রহণ করে ভুল-ত্রুতি থাকলে তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। পার্টি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দৈনন্দিন কার্য পরিচালনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকে।

দীঘিনালা পাবলাখালী দজর পাড়া গ্রামের জনগণ বাঁশ কোড়ল জব্দ ও ধ্বংস করার ছবিকে ব্যবহার করে একটি মহল পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ইউপিডিএফ ও জনগণের মধ্যেকার দূরত্ব সৃষ্টি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা হয়তো এটা করছেন। অনেকে তাদের বিভ্রান্তিতে পড়ে ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে যা-তা বলে সমালোচনা করতে ফেসবুকে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন। কিন্তু ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সে এলাকার জনগণ তো ইউপিডিএফ সম্পর্কে ভালোই জানে এবং কারা বাঁশ কোড়ল ধ্বংস করে দিয়েছে, কেন ধ্বংস করে দিয়েছে সেটাও এলাকার লোকজন জানে। কাজেই সাময়িকের জন্য কিছু লোক বিভ্রান্তের শিকার হলেও মূল বিষয়টি বুঝতে পারলে তারাও নিশ্চয় নিজেদের শুধরে নিতে বাধ্য হবে।

লক্ষ্যণীয় যে, বাঁশ কোড়ল ধ্বংসের ছবিটি প্রথমে যারা ফেসবুকে ছবি ছড়িয়েছিল তারা জেএসএস সংস্কারপন্থী দলের সাথে সম্পৃক্ত। তারা মূল ঘটনাস্থলটি আড়াল করে ঘটনাটি সাজেকে ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছেন। এখানে ঘটনাস্থল সাজেক উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, সাজেক এখন এক পরিচিত নাম। সেখানে যা কিছু ঘটবে তা সহজেই লোকে বিশ্বাস করে থাকে। সেজন্য তারা আসল ঘটনা ও ঘটনাস্থল উল্লেখ না করে সাজেককে বেঁছে নিয়ে বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া কোন তথ্য যাচাই-বাছাই না করে অযথা বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সকলের প্রতি সবিনয়ে আহ্বান জানাই।

পাহাড়ি জনগণকে এটাই ভূলে গেলে চলবে না যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠির শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে একমাত্র ইউপিডিএফ-ই সোচ্চার থেকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সংগ্রাম করে যাচ্ছে এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার করতে ইউপিডিএফ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য নেতা-কর্মী জীবন-যৌবন বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছেন। 

বাঁশ কোড়ল পাহাড়-সমতলে বিভিন্ন জাতিসত্তার খাবারের সবজি তালিকায় অন্যতম। বর্তমানে তো বাঙালিরাও এটিকে সবজি হিসেবে খাবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছেন। জুন-আগস্ট মাসে বাঁশ প্রজননের প্রধান সময়। এ সময় বেশিরভাগ বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায়। কিন্তু খাবার হিসেবে বাঁশ কোড়ল জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বাঁশ কোড়ল নিধন হয়ে যাচ্ছে। যা বাঁশ উৎপাদন সংকুচিত হচ্ছে। কারণ বাঁশ কোড়ল পুরোপুরি বাঁশে পরিণত হলেই কেবল তার থেকে নতুন বাঁশ জন্মায়। কাজেই, বাঁশ কোড়ল বিক্রি করে মানুষ যতটা আয় করছে তার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতি শিকার হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ কোড়ল বিক্রি করে বাঁশ উৎপাদন ধ্বংস করার মাধ্যমে। 

আর এটাও বোঝা দরকার যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অতীতে যেভাবে ঘন বাঁশঝাড় ছিল এখন আর তা নেই। বর্তমানে ভোগদখল ব্যতীত বাঁশ বাগান খুবই সীমিত। সুতরাং, যারা বাঁশ কোড়ল বিক্রি করে তাদের বেশিরভাগেরই কিন্তু নিজস্ব কোন বাঁশ বাগান নেই। অন্যের বাগান থেকে যে কোন উপায়ে তারা বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে এসে বিক্রি করে থাকে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশ-গাছ ধ্বংস, পাথর উত্তোলন, পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করে পরিবেশ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে গত ২৮ জুলাই বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ দিবস উপলক্ষে বন-পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং তা রক্ষার্থে ইউপিডিএফের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে জনসচেতনমূলক নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। 

২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপিডিএফ-এর ১ম জাতীয় কংগ্রেসে পাসকৃত সম্পুরক দাবিনামায় ১১ নম্বরে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ৮টি দাবি উল্লেখ রয়েছে। এ লক্ষ্যে ইউপিডিএফ তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশ উৎপাদন কমে যাওয়ায় ইউপিডিএফ ২০০৯-১০ সাল থেকে এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করা, বাঁশ কোড়ল বাণিজ্য (বেচা-বিক্রি) রোধ কল্পে প্রচারপত্র বিলি, এলাকায় এলাকায় গণমিটিং আয়োজনসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে। খাগড়াছড়ি স্বনির্ভর বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি এলাকায় ঢোল পিটিয়ে মাইকিং করা হয়েছে। এছাড়াও পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে হাতে লেখা পোষ্টারিং করার কাজ এখনো অব্যাহত রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে নানা কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ূ পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে গোটা বিশ্বের মানুষ আজ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও দিন দিন এর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবাধে বন উজাড়, পাথর উত্তোলন, পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ, জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস পরিবেশ বিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমরা ২০১৭ সালে রাঙামাটিসহ বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা দেখেছি। এ বছরও টানা বর্ষণে বান্দরবানসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যা ও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এসবই ঘটছে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে। তাই পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং আরো বেশি সচেতন হতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনৈতিক দূরদর্শীতার চিন্তা ধারণা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন-পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষার্থে সচেতনতামূলক প্রয়োজনীয় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু হতভাগা কতিপয় মানুষ ইউপিডিএফ'র এসব কর্মসূচিকে ঘিরে প্রতি বছর নানা বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে ও লেখালেখি করে ফায়দা লুটতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

কাউকে হয়রানি করে, শোষণ, নির্যাতন করে স্বার্থ আদায় করা ইউপিডিএফ-এর কাজ নয়। মিথ্যা অপপ্রচার করে দলীয় স্বার্থ আদায়ের বিন্দু মাত্র চেষ্টাও ইউপিডিএফের নেই। ইউপিডিএফ যা করে সামগ্রিক স্বার্থে ভবিষ্যত দূরদর্শীতা চিন্তা থেকে করে থাকে। আমরা আশা করছি সকল বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন-পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষার্থে পার্বত্যবাসী ইউপিডিএফ-এর সাথে একাত্মতা পোষণ করবেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে সুরক্ষায় এগিয়ে আসবেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url